বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
ভূমিকা
বারি লাউ ৫ - বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি
লাউয়ের ইংরেজী নাম gourd। শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে লাউ অন্যতম। এর পাতা সরল ও একান্তর, বোঁটা লম্বা এবং ভেতরে ফাঁপা থাকে। আমাদের দেশে অনেক ধরনের লাউ চোখে পড়ে। ফলের আকার-আকৃতি ও বর্ণের কারণে বিভিন্ন জাত নির্ণয় করা যায়। বর্তমানে সারাবছরই এ সবজিটি পাওয়া যায়। এর ব্যবহার হয় অনেক ধরনের খাবারে। তাই আগাম ফসল পেতে হলে এখনই লাউ চাষ করা দরকার।
জলবায়ু : আমাদের দেশে শীতকালে এ সবজিটি ভালো হয়। পরিবেশের দিক থেকে এটিই হচ্ছে উপযুক্ত সময়। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আলো-বাতাস এবং তাপমাত্রা ভালো ফল উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।
মাটি : সব ধরনের মাটিতেই লাউ হয়। দো-আঁশ মাটিতে ফলন সবচেয়ে ভালো হয়। বেলে মাটিতে লাউয়ের ফলন পেতে হলে প্রচুর পরিমাণ জৈবসার আর পানির প্রয়োজন হবে। বর্তমানে বেলে মাটিতে লাউয়ের ভালো ফলন হচ্ছে, তা চরাঞ্চলের দিকে খেয়াল করলে বোঝা যায়।
জাত : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি লাউ-১ নামে উচ্চফলনশীল একটি জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে লাউয়ের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। এ জাতটি সারা বছরই চাষ করা যায়। বর্তমানে ইস্টওয়েস্ট সিড কোম্পানির হাইব্রিড লাউ মার্টিনা ও জুপিটার ব্যাপক আবাদ হচ্ছে।
মাদা তৈরি-বীজ বপন : বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি
ভালো মাদা তৈরি করতে দরকার হয় উঁচু জমি। মাদায় প্রয়োজনীয় সার দেয়ার ৭ থেকে ১০ দিন পর প্রতি মাদায় ৩-৪টি করে বীজ বপন করতে হয়। জমিতে আইল তৈরি করে লাউয়ের চারা রোপণ করা যায়। এক্ষেত্রে আইলের প্রতি মাদায় একটি করে চারা রোপণ করতে হবে।
বীজ বপন ও চারা উৎপাদন : লাউ চাষের জন্য দুইভাবে বীজ বপন করা যায়। সরাসরি ক্ষেতে তৈরী মাদায় বীজ বপন করে অথবা পলিথিনের ব্যাগে চারা তৈরি করে। ৫০ ভাগ পচা গোবর অথবা জৈবসার সমপরিমাণ বেলে মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে পলিথিন ব্যাগের জন্য মাটি তৈরি করে নিতে হবে। পলিথিন ব্যাগের ব্যাস ৭.৫ সেন্টিমিটার ও উচ্চতা ১২-১৫ সেন্টিমিটার হবে।
পানি বের হওয়ার জন্য ব্যাগের তলায় দুই-তিনটি ছিদ্র করে দিতে হবে। অপর দিকে সরাসরি মাদায় বীজ বপন করতে হলে প্রথমে ৩০×৩০×৩০ সেন্টিমিটার পরিমাপের মাদা তৈরি করে সার প্রয়োগ করার পর প্রতি মাদায় চার-পাঁচটি বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপনের ১০-১৫ দিন পর প্রতি মাদায় দু’টি করে সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে।
বীজ বপনের গভীরতা : ২.০-২.৫ সেন্টিমিটার। ৪-৫ দিনের মধ্যেই চারার অঙ্কুরোদ্গমন হবে।
বীজ বপনের সময় : শীতকালীন লাউ চাষের জন্য সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে বীজ বপন করতে হয়।
বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি বৈশিষ্ট্য :
১। এটি একটি উচ্চফলনশীল জাত।
২। ফল বড় আকারের (গড় ওজন১.৯০-২.০০ কেজি)।
৩। ফল দেখতে লম্বা ও বোতল আকৃতির।
৪। ফল গাড় সবুজ রঙের এবং ফলের নিচের দিকে সাদা ছিট ছিট দাগ আছে।
৫। গাছ প্রতি গড়ে ফলের সংখ্যা ১২ টি এবং গড় ফলন প্রায় ৪৯.৮৯ টন/হেক্টর।
উপযোগী এলাকা : সারা দেশে চাষ উপযোগী
বপনের সময় :
ফেব্রুয়ারী-মে (গ্রীষ্মকালে)
আগস্ট থেকে অক্টোবর (শীতকালে)
মাড়াইয়ের সময়: বীজ বপনের ৯০ দিনের মধ্যে ১ম ফল সংগ্রহ করা যায়
বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
রোগবালাই:
- এনথ্রাকনোজ বা ফল পঁচা
- পাউডারী মিলডিউ
- ডাউনী মিলডিউ
- ঢলে পড়া (উইল্ট)
দমন ব্যবস্থা:
এনথ্রাকনোজ বা ফল পচা:
১। রোগমুক্ত ভাল বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২। ফল পুরোপুরি না পাকিয়ে ক্ষেত থেকে তুলে নিতে হবে।
৩। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যাভিষ্টিন/ নোইন বা একোনাজল আক্রমণের শুরুতেই প্রয়োগ করতে হবে।
৪। লাউয়ের বীজ-ফলে অব্যশই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে বীজ রোগমুক্ত রাখতে হবে।
মোজাইক - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
১। আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার রাখা।
২। ক্ষেতে বাহক পোকার উপস্থিতি দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করে তা দমন করা।
৩। রোগাক্রান্ত গাছ থেকে কোন বীজ সংগ্রহ ও ব্যবহার না করা।
পাউডারী মিলডিউ - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
১। এ রোগের প্রতিকারের জন্য আক্রান্ত পাতা ও গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২। তাছাড়া ২ গ্রাম থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউপি অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা সালফোলাক্স/ কুমুলাস ০.৫ মিলি অথবা ১ গ্রাম ক্যালিক্সিন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ডাউনী মিলডিউ - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
- ১। এ রোগ দমনে ২ গ্রাম থিয়োভিট প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
- 2। চারা রোপন করার সময় মাদাতে কিছু ছাই দিলে এ রোগ দমন করা যায়।
পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থা - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
- পোকামাকড়:
- মাছি পোকা
- পামকিন বিটল
দমন ব্যবস্থা:
ফলের মাছি পোকা: - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
দুই ধাপে এ পোকা কার্যকারভাবে দমন করা যায়।
১। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদঃ মাছি পোকায় আক্রান্ত ফল দ্রুত পচে যায় এবং গাছ হতে মাটিতে ঝরে পড়ে। এই ফল কোন ক্রমেই জমির আশেপাশে ফেলে রাখা উচিত নয়।
কারণ উক্ত ফলে লুকিয়ে থাকো পরিপূর্ণ কীড়া অল্প সময়ের মধ্যেই পুত্তুলি ও পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়ে নতুন ভাবে আক্রমণ শুরু করতে পারে। আক্রান্ত ফলসমূহ সংগ্রহ করে (যেহেতু এ পোকার কীড়া সর্মহ মাটির ১০-১২ সেমি গভীরে পুত্তলিতে পরিণত হয়) কমপক্ষে ৩০ সেমি পরিমাণ গর্ত করে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে অথবা হাত বা পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।
২। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহারঃ কিউওির নামক সেক্স ফেরোমন পানি ফাঁদের মাধ্যমে ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে পুরুষ মাছি পোকা আকৃষ্ট করে মাছি পোকা সর্মহকে মেরে ফেলা যায়।
ফাঁদ প্রতি এক মিলি পরিমাণ সেক্স ফেরোমন একখন্ড তুলার টুকরায় ভিজিয়ে পানি ফাঁদের প্লাষ্টিক পাত্রের মুখ হতে ৩-৪ সেমি নীচে একটি সরু তার দিয়ে স্থাপন করতে হবে। ফেরোমনের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ মাছি পোকা প্লাষ্টিক পাত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ও সাবান পানিতে পড়ে আটকে মারা পড়ে।
বিষটোপ ফাঁদে পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছি পোকা আকৃষ্ট হয় এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। একশত গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়া কুচি কুচি করে ক্টে তা থেতলিয়ে ০.২৫ গ্রাম মিপসিন ৭৫ পাউডার অথবা সেভিন ৮৫ পাউডার এবং ১০০ মিলিলিটার পানি মিশিয়ে ছোট একটি মাটির পাত্রে নিয়ে তিনটি খুঁটির সাহায্যে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে বিষটোপের পাত্রটি মাটি থেকে ০.৫ মিটার উঁচুতে থাকে।
বিষটোপ তৈরির পর ৪-৫ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করে তা ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে তৈরি বিষটোপ ব্যবহার করতে হয়। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ কুমড়া জাতীয় ফসলের জমিতে ১২ মি দুরে দূরে স্থাপন করতে হবে।
পামকিন বিটল: - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
১। চারা আক্রান্ত হলে হাত দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলা।
২। ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার রাখা।
৩। চারা অবস্থায় ২০-২৫ দিন পর্যন্ত মশারির জাল দিয়ে চারাগুলো ঢেকে রাখলে এ পোকার আক্রমণ থেকে গাছ বেঁচে যায়।
৪। আক্রমণের হার বেশী হলে চারা গাজানোর পর প্রতি মাদার চারদিকে মাটির সাথে চারা প্রতি ২-৫ গ্রাম অনুমোদিত দানাদার কীটনাশক (কার্বোফুরান জাতীয় কীটনাশক) মিশিয়ে গোড়ায় পানি সেচ দেয়া।
বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি - সার ব্যবস্থাপনা
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ (কেজি / হেঃ)
সারের নাম | মোট পরিমাণ | জমি এ মাদা তৈরির সময় | চারা লাগানোর ১৫ দিন পর | চারা রোপণের ৩৫ দিন পর | চারা রোপণের ৫৫ দিন পর | চারা রোপণের ৭৫ দিন পর |
গোবর | ১০০০০কেজি | সব | - | - | - | - |
ইউরিয়া | ১৫০কেজি | - | ৩৭.৫কেজি | ৩৭.৫কেজি | ৩৭.৫কেজি | ৩৭.৫কেজি |
টিএসপি | ১৭৫কেজি | সব | - | - | - | - |
এমপি | ১৫০কেজি | ৫০কেজি | ২৫কেজি | ২৫কেজি | ২৫কেজি | ২৫কেজি |
জিপসাম | ১০০কেজি | সব | - | - | - | - |
জিংক অক্সাইড | ১২কেজি | সব | - | - | - | - |
বোরাক্স | ১০কেজি | সব | - | - | - | - |
উপসংহার
প্রিয় পাঠক আজ বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম। আগামীতে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি উপরের বারি লাউ ৫ চাষ পদ্ধতি - রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা আলোচনা আপনার ভালো লেগেছে। এ সমন্ধে যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানান আর আপনার ফ্রেন্ড সার্কেলে এই কনটেন্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। আমাদের সাথেই থাকুন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url