রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থা - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা

ভূমিকা

কৃষি এবং কৃষির সাথে যুক্ত সকলকেই শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের এই কনটেন্ট লেখা শুরু করছি। আমরা আলোচনা করব বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ বা বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা নিয়ে।

বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ -  বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যাবেগুন চাষ করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি সেই সমস্যাগুলোর সমাধান থাকছে আজকের এই কনটেন্টটিতে বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা ছাড়াও শেষে আলোচনা করব বেগুনে কিভাবে সার প্রয়োগ করবেন এবং বেগুন কিভাবে সংগ্রহ করবেন।

বীজ বপন ও চারা উৎপাদন - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা

বেগুন চাষের জন্য চারা উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শীতকালীন বেগুন চাষের জন্য শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি হতে আশ্বিন মাস এবং বর্ষাকালীন বেগুন চাষের জন্য চৈত্র মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা যায় ।

বালি, কমপােস্ট ও মাটি সমপরিমাণে মিশিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হয়। বীজ গজানাের ৮-১০ দিন পর চারা তুলে দ্বিতীয় বীজতলায় রােপণ করতে হয় ।

জমি নির্বাচন - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা 

দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি বেগুন চাষের জন্য সবচেয়ে ভালাে। তবে পানি অপসারণের ভালাে ব্যবস্থা থাকলে এঁটেল ও দোআঁশ মাটিতেও বেগুনের চাষ করা যায়।

জমি তৈরি জমি - বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০

তৈরির জন্য ৪-৫ বার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে তৈরি করতে হবে। ভালাে ফসল পেতে হলে জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে।
বারি বেগুন ১ (উত্তরা) এর বৈশিষ্ট্য :

বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ এর বৈশিষ্ট্য :

১। এই জাতের গাছ খাটো আকৃতির এবং ছড়ানো।
২। ফল সরু ও ১৮-২০ সেমি লম্বা।
৩। প্রতিটি গাছে গড়ে ৪০-৪৫ টি ফল ধরে।
৪। ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ সহনশীল এবং ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম।
৫। হেক্টরপ্রতি ফলন ৪৫-৫০ টন।

উপযোগী এলাকা : 
সারা দেশে চাষ উপযোগী, তবে রাজশাহী এলাকায় এই জাতের ব্যাপক চাষ হয়।

বপনের সময় : সেপ্টেম্বর-অক্টোবর

মাড়াইয়ের সময়: 
চারা লাগানোর ২-৩ মাস পরই ফসল সংগ্রহের সময়। সাধারনত ফল ধারনের ২৫-২৭ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়।

সার ব্যবস্থাপনা - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা

সার প্রয়ােগের নিয়মাবলি
ক) ইউরিয়া ছাড়া সব সার জমির শেষ চাষের সময় প্রয়ােগ গােবর। তবে গােবর জমি তৈরির প্রথম দিকে প্রয়ােগ করাই উত্তম।

খ) ইউরিয়া সার চারা গজানাের ৮-১০ দিন পর থেকে এমওপি। ৫০০ গ্রাম । ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ কিস্তিতে উপরি প্রয়ােগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

চারা রােপণ - বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০

এক মাস বয়সের সবল চারা কাঠির সাহায্যে তুলে নিতে হবে। চারা গাছের শিকড়ের যেন ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর পর ৭৫ সেমি দূরত্বের সারিতে ৬০ সেমি দূরে দূরে চারা রােপণ করতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ (কেজি / হেঃ)

সারের নাম

মোট পরিমাণ

শেষ চাষের সময়

চারা লাগানোর ১০-১৫ দিন পর

ফল ধরা আরম্ভ হলে

ফল আহরণের মাঝামাঝি সময়

গোবর/কম্পোস্ট

১০০০০কেজি

সব

-

-

-

ইউরিয়া

৩০০কেজি

-

১০০কেজি

১০০কেজি

১০০কেজি

টিএসপি

২০০কেজি

সব

-

-

-

এমপি

২০০কেজি

৫০কেজি

৫০কেজি

৫০কেজি

৫০কেজি

জিপসাম

১০০কেজি

সব

-

-

-

দস্তা সার

১২কেজি

সব

-

-

-

বোরাক্স

১০কেজি

সব

-

-

-

রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থা - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা 

রোগবালাই:
  • কান্ড পচা
  • ফল পচা (ফমপসিস ব্লাইট)
  • ঢলেপড়া রোগ
  • গুচ্ছপাতা
দমন ব্যবস্থা:

কান্ড পচা ও ফল পচা (ফমপসিস বলাইট)

১। সুস্থ-রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা, সেচ বা বৃষ্টির পর গাছের গোড়ার মাটি আলগা করা।
২। প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম ভিটাভেক্স ২০০ দিয়ে শোধন করা
৩। রোগ কান্ডে দেখা দিলে গাছের গোড়াসহ মাটি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পরিমাণ ব্যভিস্টিন/নোইন গুলিয়ে ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। বীজ বেগুনে রোগ দেখামাত্র ছত্রাকনাশক স্প্রে করা।

৪। রোগ হয় এরুপ জমিতে কমপক্ষে ৩ বছর বেগুন-টমেটো জাতীয় সবজির সাহায্যে শষ্য পর্যায় অনুসরন করা। ফসল সংগ্রহের পর সমস্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলা।

ঢলেপড়া রোগ - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা 

১। আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা।
২। বন বেগুন যথা টরভাম বা সিসিম্ব্রিফলিয়ামের সাথে জোড় কলম করা। যা বর্তমানে সীমিত আকারে কৃযক পর্যায়ে ব্যবহার শুরু হয়েছে।

গুচ্ছপাতা - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা 

১। আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা।
২। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার রাখা।
৩। ক্ষেতে জেসিড পোকার উপস্থিতি দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করে তা দমন করা।

পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থা -  বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা 

পোকামাকড়:
  • বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা
  • পাতার হপার পোকা
  • কাঁটালে পোকা বা ইপল্যাকনা বিটল
  • সাদা মাছি পোকা
দমন ব্যবস্থা:

বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা 

১। পোকা আক্রান্ত ডগা ও ফল ধ্বংস করাঃ ফল ধরার আগে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার কীড়া বেগুনের ডগার ভেতর খেয়ে বৃদ্ধি পায়। সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন উক্ত কীড়া সমেত আক্রান্ত ডগা কেটে ধ্বংস করে ফেললে পোকার বংশবৃদ্ধি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

২। সেক্স ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহারঃ সূক্ষ ছিদ্রসহ প্লাষ্টিকের ছোট টিউবে ২-৩ মি গ্রা পরিমাণ ফেরোমন ভরে টিউবটি একটি পোকা ধরা ফাঁদে ঝুলিয়ে রাখলে তা ৬-৮ সপ্তাহ পর্যন্ত পুরুষ মথ আকৃষ্ট করতে পারে, যা পরবর্তীতে সংগ্রহ করে ধ্বংস করা হয় ।

৩। বিষাক্ত কীটনাশকের প্রয়োগ বন্ধ বা সীমিত ব্যবহারঃ ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার বেশ কয়েকটি দেশীয় পরজীবি ও পরভোজী পোকা রয়েছে। এদের মধ্যে পরজীবি পোকা যেমনঃ ট্রাথালা ফ্লেভো-অরবিটালিস ও পরভোজী পোকা যেমনঃ ম্যনটিড, এয়ার- ইউগ, পিঁপড়া, লেডি বার্ড বিটেল, মাকড়সা ইত্যাদি বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য। 

বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করা বেগুনের জমিতে এরা প্রচুর পরিমাণে ডগা ও ফলছিদ্রকারী পোকাই কেবল ধ্বংস করে না সাথে সাথে অন্যান্য ক্ষতিকারক পোকা যেমনঃ জ্যসিড, সাদা মাছি ইত্যাদির সংখ্যা স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে সাহায্য করে। 

সুতরাং একান্ত প্রয়োজনে কেবলমাত্র পরিমিত মাত্রায় নির্দিষ্ট ক্ষমতা সম্পন্ন রাসায়নিক কীটনাশক অথবা স্থানীয়ভাবে সুপারিশকৃত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।

পাতার হপার পোকা/ জেসিড / থ্রিপস - বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ 

১। প্রতিরোধী জাত যেমন বারি বেগুন-৬ বা বারি বেগুন-৮ চাষ করা।
২। নিমতেল ৫ মিলি + ৫ মিলি ট্রিকস্ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
৩। এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ২০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
৪। পাঁচ গ্রাম পরিমাণ গুড়া সাবান প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
৫। আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশী হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২মিলি পরিমাণ) স্প্রে করা অথবা এডমায়ার ২০০ এস এল (প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি পরিমাণ) মিশিয়ে স্প্রে করা।

কাঁটালে পোকা বা ইপিল্যাকনা বিটল- বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ 

১। পোকা সহ আক্রান্ত পাতা হাত বাছাই করে মেরে ফেলা।
২। নিমতেল ৫ মিলি + ৫ মিলি ট্রিকস্ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
৩। এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি স্প্রে করা।
৪। আক্রমণ অত্যন্ত বেশী হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২মিলি পরিমান) স্প্রে করা।

সাদা মাছি পোকা - বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ 

১। ৫০ গ্রাম সাবান/সাবানের গুড়া ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নীচে সপ্তাহে ২-৩ বার ভাল করে স্প্রে করা।
২। ফসলের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করা।
৩। হলুদ রংয়ের আঠা ফাঁদ ব্যবহার করা।
৪। সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে এবং আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশী হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২মি লি পরিমান) অথবা এডমায়ার ২০০ এস এল (প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মি লি পরিমান) মিশিয়ে স্প্রে করা। তবে ঘন ঘন ও বার বার কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ এর ফলে এ পোকা কীটনাশকের প্রতি দ্রুত সহনশীলতা গড়ে তোলে।

লাল মাকড় - বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা 

১। নিমতেল ৫ মিলি + ৫ মিলি ট্রিকস্ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
২। এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
৩। আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশী হলে মাকড়নাশক ওমাইট/ টলস্টার/ ভার্টিমেক (প্রতি লিটার পানিতে ২মিলি পরিমাণ) স্প্রে করা।

ফসল সংগ্রহ ও ফলন - বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০

চারা রােপণের ৩০-৪০ দিনের মধ্যে গাছে ফুল আসে । বেগুনের ফল বীজ শক্ত হওয়ার আগেই সংগ্রহ করতে হয়। সাধারণত প্রতি শতকে বা ৪০ বর্গমিটার জমিতে ১৪০ কেজি বেগুন উৎপন্নহয়। উত্তরা বেগুন ২৫০ কেজি পর্যন্ত ফলন দেয়।

বিপণন - বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০

বেগুন ফসল সংগ্রহের পর ঠাণ্ডা ও খােলা জায়গায় কয়েক দিন সংরক্ষণ করা যায়। তবে বস্তায় বেশিক্ষণ রাখা ঠিক হবে না। এতে বেগুন তার স্বাভাবিক রং হারাতে পারে এবং পচে যেতে পারে।

উপসংহার

আজকে আমরা আলোচনা করলাম বারি বেগুন ১ (উত্তরা), বারি বেগুন ১০ বা বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা । আজকের এই কনটেন্টটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার যে কোন সমস্যা লিখতে পারেন কমেন্ট বক্সে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url